Skip to main content

যোগী থেকে তাজিংডং - বারবার ফিরে যাওয়া পথের গল্প

দু'তিন মাসে একবারে ঘুরতে বের হওয়া আমাদের মত কিছু মানুষের এই হয়েছে কাল! ঘুরে আসার পর সবার সাথে অভিজ্ঞতাটুকু ভাগাভাগি না করলে (পড়ুন সবাইকে না জানালে!) কেমন যেন মনে হয় ভ্রমণ সম্পূর্ণ হল না! ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে যুক্ত হয় লিখে মনের ভাব প্রকাশের অপারগতা এবং লেখা লিখে শেষ না করা পর্যন্ত দুর্বার মানসিক যাতনা! ট্যুরে কষ্ট করে ঘুরে আসার পর, সুতীক্ষ্ণ (!) লেখনি দিয়ে সবাইকে কষ্ট না দিলে কিসের আবার ঘুরাঘুরি!

সেই দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই তাই এ উপস্থাপনা! 

যাত্রার প্রাক্কালে পরিকল্পনা করেই বরাবর বের হওয়া আমাদের অভ্যাস। সবাইকেই সেই একই পরামর্শও আমরা দিয়ে থাকি। সে যাইহোক, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা যাত্রা শুরু করি আলিকদম থেকে তিন্দু হয়ে রেমাক্রি এবং রেমাক্রি থেকে দলিয়ান পাড়ার উদ্দেশ্যে। দলিয়ান পাড়ায় দু’তিনদিন থেকে যোগী পাহাড় সামিট করে, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম রুটে, প্রায় ২৫ কিলো পাহাড়ি পথ ভেঙে শেরকর পাড়া এবং ওখান থেকে তাজিংডং। পথিমধ্যে লক্ষ্য, বেশকিছু নতুন পাড়া একটু করে হলেও ঢুঁ মারা, নানানভাবে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করার প্রয়াস বলতে পারেন। 

তো চলুন, নিয়ে যাই আপনাদের, বাংলাদেশের সৌন্দর্যের রানী বলে সর্বজনবিদিত, বান্দরবানের কিছু গভীর অঞ্চলে।

দিন ১--

আলিকদমের ২১ কিলো থেকে যখন আমাদের হাঁটা শুরু করি, সবাই কম-বেশি জানতাম, তিন্দু পৌঁছাতে ২-৩ ঘণ্টা ঢালু পথে নেমে যেতে হবে। তবে শীতের শেষের রোদ, তীব্র এক পরীক্ষা নিতে পারে, সত্যি বলতে তা একদমই মাথায় আসে নি! এই ইট বসানো ঢালু পথ শেষে তিন্দুর সাঙ্গু ঘেঁষা পাড়ে যখন গিয়ে বসলাম, ভালই ক্লান্ত লাগছিলো। শুধু এতটুকু বলে আসলে এই পথের কষ্ট সম্পূর্ণ বোঝানো সম্ভব না। শুধুমাত্র ইট বসানো কাঁচাপাকা পাহাড়ি ঢালু রাস্তা শুনতে তেমন কিছু মনে না হলেও, সাথে প্রখর রোদ যুক্ত হয়ে দেহের শেষ শক্তিটুকুও শুষে নেয়। কিন্তু পথ তো মাত্র শুরু, সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষায় আছে আরও কষ্টসাধ্য পথ। তবে আশার কথা, কষ্টসাধ্য হলেও, পথ হবে চমকপ্রদ, যা আবেশিত করে রাখবে অনেকদিন, তা ভালোই জানা ছিল এবং বরাবরের মত আশাহত তো হইনি বরং দীর্ঘদিন বিমোহিত থাকার রসদ নিয়েই ফিরেছি।

তিন্দু থেকে শুরু হল সেই পরিচিত, শ্যালোবোট দিয়ে, রেমাক্রি-এর উদ্দেশ্যে ঘণ্টাখানেকের পথ। শীতের শেষে সাঙ্গুতে পানি খুবই অল্প। স্বচ্ছ পানি ভেঙে শ্যালো আমাদের নিয়ে নামালো রেমাক্রিতে। মাস চারেক আগেও এই পথে ঘুরে গিয়েছিলাম। এবার আরও সরগরম হয়েছে এলাকাটি। সামনের দিনগুলোতে অনেকেই এ সমাগম এড়িয়ে যাবে, এখনি বলে দেয়া যায়! এর মধ্যে দেখি নতুন চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। শেষবার এসে দেখিনি। ভালোই!  

রেমাক্রিতে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষ করে এবার পথ ধরলাম দলিয়ান পাড়ার। দলিয়ান পাড়াকে বলা যায় জোতলাং-যোগী হাফং-এর বেসক্যাম্প। এখানে একটু জানিয়ে রাখি, জোতলাং-যোগী হাফং যথাক্রমে আনঅফিসিয়ালি বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সর্বোচ্চ চূড়া। দলিয়ান পাড়ায় যাবার রাস্তা সহজ-সুন্দর। রেমাক্রি থেকে খাড়া বেশকিছু পথ উঠে যেতে হয়। তারপর নিয়মিত বিরতিতে পাহাড় অথা-নামা। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে আমরা পৌঁছে যাই পাড়ায়। 

আমরা বলতে আমাদের এবারের পাঁচজনের দল। সবাই নানান অভিযাত্রায় আমার পূর্বপরিচিত মানুষজন। ছিলেন তানিন ভাই এবং ফারিহা আপু দম্পতি, খোরশেদ ভাই, নিপু ভাই এবং এই অধম। সাথে গাইড হিসেবে ছিলেন জিয়ন দাদা।

পাড়ায় পৌঁছেই আমরা চলে যাই আমাদের জন্য ঠিক করা ঘরে। সে সন্ধ্যায় পাড়ায় তেমন একটা ঘোরা হয়নি আর। দীর্ঘ পথ আর আলিকদম থেকে তিন্দু যাত্রা কিঞ্চিত দুর্বলও করে দিয়েছিলো বলতেই হয়। পাড়ায় থাকার ক্ষেত্রে নিয়মটা বেশ গোছানো। প্রতিবার যখন কোন গ্রুপ পাড়ায় থাকতে আসে, নিয়মানুযায়ী, একেকবার একেক ঘরে হয় তাদের ঠিকানা। পাড়ার বাসিন্দা, যারা গেস্ট রাখবেন, তারা সবাই যাতে সুযোগ পান, সবসময় এক পরিবারকেই যাতে গেস্ট না রাখতে হয়, সে উদ্দেশ্যেই এ নিয়ম। রোটেশন পদ্ধতিতে তাই কেউ বঞ্চিত হন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এবার রোটেশন পদ্ধতিতে আমাদের যে পরিবারের সাথে থাকা ঠিক হয়, তাদের ঘরে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর পর আমরাই নাকি প্রথম অতিথি! সময়ের ব্যবধানের জন্যেই কি না কে জানে, যে কদিন দলিয়ান পাড়া ছিল আমাদের ঠিকানা, সে কদিন আপ্যায়নের কোন কমতি হয়নি। দলিয়ান পাড়া এমনিতেই যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন, তার ওপর পাড়ার এক দিকে আমাদের আবাস নির্ধারিত হওয়ায়, খুব শান্তিতেই আমরা দুই রাত এ পাড়ায় অতিবাহিত করার সুযোগ পাই এবং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার না করার মত ভুল করিনি। কেন বলছি এই কথা তাতে একটু পরেই আসছি।

প্রথম যখন দলিয়ান পাড়ায় প্রবেশ করি, হেটে আসবার কারণেই কিনা, ঠাণ্ডাটা ঠিক বুঝে ওঠা যায়নি। ঘরে ঢোকার পর রাত যত গভীর হল, ঠাণ্ডার মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। ১২-১৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বোধহয় নেমেছিলো, মাপা হয়নি। জানালা বন্ধ করে, বাঁশের মেঝের খোলা অংশগুলো যুতসইভাবে ঢেকে, সবাই ৩-৪টা কম্বলের নিচে নিজেদের গুজে দিয়ে, দিলাম এক ঘুম!

কিছুটা অনাড়ম্বরভাবে, এভাবেই সমাপ্ত হয় আমাদের প্রথম দিনের।

দিন ২--

জোতলাং-যোগী হাফং সামিটের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, শুরু করতে হবে খুব ভোরে। কারণ দুটো- দীর্ঘ, বন্ধুর পথ এবং ফেরার সময় রাতে হাইকিং এড়িয়ে যাওয়া। আমরাও সেই রীতির বাইরে যাবার কোন কারণ পাইনি এবং খুব ভোরে না হলেও, যথাসময়ে পথে নেমে যাই। গতকালের আলিকদম থেকে তিন্দু পথটুকু সবাইকেই খুব ক্লান্ত করে দিয়েছিল। সবারই পায়ের অবস্থা কিঞ্চিত সঙ্গিন। যোগী সামিটের জন্য যা আসলে একটা ভালো প্রতিবন্ধকতা। তবুও বান্দরবানের পাহাড়ি পথে হাঁটাচলার অভ্যাস থাকায় কেউই আমরা তেমন গা করিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, একটু হাঁটলেই পায়ের ‘লক’ আস্তে আস্তে খুলতে থাকবে! আমরাও তাই দ্বিধাহীনভাবে যাত্রা শুরু করে দেই। পথে রান্নার জন্য যাবতীয় তৈজসপাতি (পাতিল, ছোট্ট গ্যাসের চুলা, গ্যাসের ক্যান, চামচ, খাবার বাটি, ওয়ানটাইম গ্লাস), সকালে নাস্তার জন্য পাড়া থেকেই খিচুরি আর সিদ্ধ ডিম, রেশন হিসেবে স্যুপ, নুডলস নিয়ে নেয়া হয়।

দলিয়ান পাড়া-যোগী-দলিয়ান পাড়া মোটামুটি ৮-১০ ঘণ্টার পথ, তাই পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে নেয়াটা ভীষণ জরুরি। পাড়া থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওয়াই জংশন বলে পরিচিত এক বাঁকে পৌঁছে গেলাম আমরা। ওয়াই জংশন থেকে একটু সামনে গিয়েই ডানে ঝিরি ধরে জোতলাং এবং বায়ে যোগী-এর পথ। আমাদের আজকের গন্তব্য যেহেতু শুধুই যোগী, আমরা তাই বাম দিকের পথে হাঁটা ধরলাম। ঝিরি ধরে কিছুটা সামনে এগুতেই, সবার উদর সবাইকে মনে করাতে শুরু করলো- বাছা, যাচ্ছ কোথায়? নাস্তা করতে হবে না?! আমাদের প্ল্যানটাই ছিল পথে নাস্তা করার। উদর মহাশয়কে সন্তুষ্ট করতে তাই ঝিরিতে রান্না করতে বসে গেলাম আমরা। নাস্তা তৈরিই ছিল, পাড়া থেকে নিয়ে আসা খিচুরি-ডিম। চুলার আয়োজনের হেতু ছিল মূলত চা। বাঙালি মানুষ, নাস্তা করার পর চা না হলে কেন যেন ঠিক জমে না।


এই ঝিরি পথটা যথেষ্ট গোলমেলে। পথ ক্রমাগত উঠে গেছে উপরের দিকে এবং বোল্ডারগুলোও আকারে বেশ বড়। আমার কাছে মূলত এ কারণটাকেই দায়ী মনে হয়েছে যোগীর পথ কঠিন করে দেবার জন্য। সে যাইহোক, এই পথকে বাঘা বাঘা ট্র্যাকাররা কেন কঠিন বলে, তা বুঝতে শুরু করলাম নাস্তা করে খানিক সামনে যাবার পর থেকে। এটা একদমই নতুন মানুষদের জন্য না! মডারেট অভিজ্ঞতার মানুষের জন্যও কষ্টের! কারণটা উপরে হাল্কা বলেছি, তবে এবার খানিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি - 

১। বোল্ডার- মোটামুটি বড় আকারের, উপরের দিকে উঠে যাওয়া বোল্ডার, কাহিল করে দেয় একদম আর পায়ের পেশিতে ভালো চাপ দেয়।
২। অনেক জায়গায় খাড়া- বাঁশ অথবা গাছের শেকড় ধরে পাথরে উঠে যেতে হয়। বৃষ্টির সময় এই বোল্ডারগুলো পিচ্ছিল হয়ে কি রূপ ধারণ করে, ভাবতেই পা অসাড় হয়ে আসে!
৩। বোল্ডার অতিক্রম করে, পা যখন কাহিল, তখনি খাড়া পাহাড় ধরে উঠে যাওয়া! সমতল জায়গাও হাতেগোনা।

বোল্ডার পার করে, বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যখন যোগীর প্রথম পিক এ পৌঁছলাম, তখন দাঁড়িয়ে থাকাও দায় মনে হচ্ছিলো! কিছুক্ষণ বসে এবার আস্তে আস্তে ২, ৩ পিক এ গিয়ে কিছু ছবি তুলে, বিশ্রাম নিতে বসলাম! আর তো পা চলে না! ইতোমধ্যে, আলিকদম থেকে তিন্দু নেমে আসার সময় ফোস্কা পরে বেহাল পদযুগল এখন আরও বিদ্রোহ করা শুরু করলো। আমাদের মধ্যে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্দান্ত ট্র্যাকার নিপু ভাই, আমাদের সাথে একটু বিশ্রাম নিয়ে ৪ নাম্বার পিক ঘুরে আসলেন ঝড়ের গতিতে! ক্যামনে কি! সেখানেই উনি আমাদের সবার থেকে বাঘা ট্র্যাকার পদবি পেয়ে গেলেন :D 

যাইহোক, এবার ফেরার পালা। সূর্য তখন মধ্য গগনে, আপন মহিমায় তপ্ততা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বেলা গড়িয়ে দুপুর এবং আমাদের পেটে ক্ষুধার উদ্রেক বেশকিছুক্ষণ থেকেই। তাই ফেরবার পথে, বাঁশঝাড়ের মাঝে ফাঁকা একটা জায়গা পেয়ে, তানিন ভাই চুলা সেট করতে বসে গেলেন। স্যুপ আর নুডলস খাবো, সেই আনন্দে, নাকি কিছুক্ষণ বসে থাকায়, ক্লান্তি বোধহয় একটু কমে আসলো! গা-হাত-পা ছেড়ে গরম গরম স্যুপ-নুডলস মিক্স খেতে খেতে ভালো একটা আড্ডাও অবশ্য হয়ে গেলো। বেশ অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা আর গত দুদিনে সবার সাথে, সৌজন্য বিনিময় ব্যতিত, ঠিকমত কথা বলার সুযোগও তেমন একটা হয়ে ওঠেনি। পাহাড়ের আড্ডাগুলো আবার একটু আলাদা- সার্কাজমে ভরপুর! সমমনা না হলে নির্ঘাত বিপত্তি! এখানেই আবার মজা, এভাবেই একই চিন্তা-ভাবনার মানুষগুলো কখন যেন নিজেদের খুঁজে পেয়ে, খুব আপন হয়ে যায়। এই যেমন, এবারের টিমের সবার কথাই বলি, একত্রে এটা কিন্তু আমাদের প্রথম ট্যুর ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলো পথ এই মানুষগুলোর সাথে ঘুরে এসেছি আমি! কিভাবে যেন অনেকটা পথ একসাথে ঘুরে বেরিয়েছি আমরা, হঠাৎ করে ভাবতে অন্যরকম আনন্দ হয়। সমতলে এখন এমনটা আর অনুভব হয় না। সবাই খুব বেশি প্রয়োজনকেন্দ্রিক!

ফেরার সময় মনে একটা চাপ ছিল। এই পথ রাতের আধারে পার করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। সবাই মোটামুটি এবার একটু পা চালিয়ে রাতের আধার জেকে বসার আগেই, বোল্ডারের পথের দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রম করে ফেলতে চাইছিলাম। একসাথে সেভাবেই তাই সাবধানে নিচে নামতে থাকলাম। পথে তিন জায়গায় খাড়া পাথর বেয়ে নামতে হবে, চ্যালেঞ্জ মাথায় এখন সেগুলোই, আর সন্ধ্যা নামার আগেই ওই পথটুকু অতিক্রমের। অতীত অভিজ্ঞতা এবং প্রপার প্ল্যানিং এর কল্যাণে, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে, ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখেই বন্ধুর পথটুকু নির্বিঘ্নে অতিক্রম করে আসতে সক্ষম হই আমরা। এবার একটু বোধহয় জিরিয়ে নেয়াই যায়! এদিকে সবার খাবার পানি শেষ। তানিন ভাইয়ের সযত্নে আগলে রাখা পানিটুকুর শেষ বিন্দু খতম করে, সবার এবার ত্রাহি ত্রাহি দশা! আশেপাশে আলো প্রায় বিলুপ্তির পথে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঠিক এমন সময়টাতেই আমরা ৭ জন এক সমতল পাথরের ওপর বসে গেলাম চা পানের আয়োজনে! পাথরটাও ছিল বেশ, ওটার নামকরণই করা হয়েছিলো টেবিল পাথর তার সমতল আকারের জন্য! গরম গরম চা শেষ করে সবাই পারলে তখন ওই পাথরেই ঘুম দেয়! কিন্তু তা তো হবার নয়। এদিকে আবার শীতের বাতাস! কি আর করা। একটু বিশ্রাম নিয়ে, ধীরলয়ে পাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। 

পথে আঁধার নেমেই গেলো। সবাই যার যার টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি! হাল্কা গল্প, মাঝে মাঝে তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে আমি একটু পিছিয়ে পরলাম। আমার সাথে লোকাল গাইড আরিফ। সবাই অনেকটাই সামনে, ওদের টর্চের আলো হঠাৎ হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো, সাথে কানে আসছিলো কথার হালকা শব্দ। জঙ্গল-ঝিরির মাঝ দিয়ে হেটে যাবার সময়, রাতের খোলা আকাশের নিচে নিজেকে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড-এর আল্যান কোয়াটারমেইন মনে হচ্ছিলো। ঘরে ফেরার নেই কোন তাড়া, কোন এক অচেনা সভ্যতার দিকে হেটে যাচ্ছি, আমি আর আরিফ! আরিফ আমাদের লোকাল গাইডের নাম, যোগী-জোতলাং যেতে দলিয়ান পাড়া থেকেই পাড়ার কাউকে নিতে হয়। তাদের পরিচিত পথ, বেশ ভালো রকম সহযোগিতাই হয় তাতে। ওভাবেই আমাদের দলে আরিফের আগমন।

রাতের সেই ঘণ্টাখানেকের পথ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ভাবুন একটু, ঘামে ভেজা মুখে শেষ শীতের শিতল বাতাস, প্রচণ্ড মায়ায় পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে, মাথার উপর হাজার তারার নকশা- মনে করিয়ে দিচ্ছে এ জগতে কতটা ক্ষুদ্র আমরা। অনুভূতিটা, সময়টা, লিখে কতটা বোঝনো সম্ভব, আমি জানি না আসলে। 

রাত ৭টার একটু পরেই পাড়ায় ঢুকলাম। মনে আনন্দ, দুপায়ের অবস্থা যদিও ভিন্ন! হাড়কাপানো ঠাণ্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে ঢুকে পড়লাম ঘরে! আজকে রাতে ভেবেছিলাম তারার ছবি তুলবো। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি! একে তো শীত, তার ওপর ক্লান্তি! নাকে-মুখে খাবার গুজে দিয়ে, গুণে গুণে গতকালকের সেই চার-চারটি কম্বলের নিচে নিজেকে চাপা দিয়ে, হারিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে!

দিন ৩--

গতকাল রাত থেকেই মন কমপ্লিট আড্ডা মুডে চলে গিয়েছিলো। আজকের দিনটা তাই ইচ্ছা ছিল অন্যভাবে কাটানোর। সবসময় দেখা যায় আমরা যারা ঘুরতে যাই, তারা পাড়ায় পাড়ায় যাই ঠিকই তবে তা শুধু রাতটুকু ঘুমানোর জায়গা হিসেবে এবং খাবার খেতে! দোষের কিছু না অবশ্যই তবে খুব অল্পই আমরা খেয়াল করি থাকার জায়গা, সে জায়গার মানুষ আর তাদের জীবনযাপনকে। এবার সেই রীতি থেকে বেরিয়ে, আজকের দিন এর পরিকল্পনাটাই করা হল আমাদের আতিথেয়তা দানকারি পরিবারের সাথে একান্ত সময় কাটানোর। সাথে যোগ করলাম গতকাল রাতে যোগী থেকে ফেরার পথে একটা সুন্দর, একাকী জুম ঘর দেখেছিলাম, ওইখানে গিয়ে সবাই একত্রে কফি খাব। 


সকালে, জম্পেশ একটা ঘুম থেকে উঠে, হাটা শুরু করলাম সেই জুম ঘরের খোঁজে! এখানে হল এক মজার ঘটনা! পাড়া থেকে জুম ঘরের পথটা ঘণ্টাখানেকের এবং বেশ সরল পথ, মোটেও খুব একটা প্যাচানো না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, অনেকক্ষণ হেটেও আর সেই জুম ঘরের দেখা পাই না! সে এক অবাক কাণ্ড! পরিষ্কার দেখলাম গতকাল আর আজকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! এবং নিয়তির খেলায়, শেষ পর্যন্ত, দুঃখজনক হলেও সেই কাঙ্ক্ষিত জুম ঘরে বসে কফি পান আর হয়ে উঠলো না। 


জুম ঘরে না হলেও, ছায়াঘেরা ঝিরির একবাকে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু বোল্ডারের ওপর বসে, আমাদের আড্ডা শুরু হয়ে গেলো। বয়ে আনা শহুরে কফি, আমরা আর আমাদের গল্প। পরের ট্রিপে কোথায় যাবো, কি ভাবে যাবো, খোরশেদ ভাই কি আসলেই ট্র্যাকিং-এ অবসর নিবেন? আগামীকাল কিভাবে কি করবো- এসব নিয়ে কথা বলতে বলতেই, দিনের মধ্যভাগ এসে হাজির। আজকের দিনের এই আড্ডা-প্রস্তুতি-বিশ্রাম খুব দরকার ছিল। আগামীকাল আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী দীর্ঘ, অচেনা পথ পাড়ি দিতে হবে। যথার্থ প্রস্তুতির অভাব সেই যাত্রা খুব ভালোভাবেই বিঘ্নিত করতে পারে এবং তা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। ধীরস্থির, সুস্থভাবে সম্পূর্ণ রুট কমপ্লিট করতে পারাটাই আমাদের লক্ষ্য।  

ফিরতি পথ ধরলাম এবার। মাঝে আজ কিছু ছবি তোলার সুযোগ পাওয়ায়, অল্প কিছু ছবি তুলে, যোগী-জোতলাংকে স্মৃতি করে, দলিয়ান পাড়ায় ফিরে এলাম। 


গোসল করে এবার বাস্তবায়নের পালা আজকের গ্র্যান্ড খানাদানা! আক্ষরিক অর্থে খাবার ম্যানু পাঠকের গ্র্যান্ড মনে নাও হতে পারে তবে বলি কি, ঘুরে আসুন একবার ওদিকে, কিঞ্চিত হাঁটাচলা করে আসুন। ঝাল মুরগির তরকারী, জুমের মিষ্টি কুমড়ো-চালডাল যে আসলেই কতটা ‘গ্র্যান্ড’, খুব বুঝতে পারবেন। দেরি না করে প্রস্তুতি, আয়োজন শুরু হয়ে গেলো। বার্বিকিউ, সবাইকে নিয়ে রান্নাবান্না, পাড়ার জীবনটা অল্প করে হলেও উপভোগ করা আর কালকের জন্য বিশ্রাম, এইতো আজকের দিন!

লালফেনদের বলতেই সানন্দে আমাদের নিয়ে বসে গেলো ওদের পরিবারের সবাই! বার্বিকিউ এর লাকড়ি, শিক সব একসাথে বসে বানিয়ে ফেললো তানিন ভাই, খোরশেদ ভাই আর লালফেন। রসুইঘরে ফারিহা আপু আর নিপু ভাই, বাহারি মসলায় সাজাচ্ছিলেন বারবিকিউ এর মাংস। আমি এদিক সেদিক ঘুরে, মনের আনন্দে ছবি তুলতে লাগলাম।

বিকালের গোধূলির আলোয় একপর্যায়ে সবাই চলে গেলাম রসুইঘরে। বার্বিকিউ এর মাংস প্রসেসিং করতে বসে গেলাম সবাই। যোগী-জোতলাং এর বেসক্যাম্প দলিয়ান পাড়ায় সেদিন ছিলাম পিকনিক মুডে! ১২-টা কাঁচামরিচ দিয়ে জাম্বুরা ভর্তা খেয়ে সবাই খালি চোখে স্পষ্ট তারা দেখতে পেয়ে, আনন্দে কান্নাকাটি করে সে এক অবস্থা!

রাতে মনোবাসনা ছিল, তরকারি আজ আমরাই রান্না করবো! আমাদের হোস্টকে অনুরোধ করতেই সম্পূর্ণ রান্না ঘর আমাদের দিয়ে দিলেন এবং ফারিহা আপু আর নিপু ভাই তাদের সকল রন্ধন প্রতিভা নিয়ে, শুরু করতে আর দেরি করলেন না! উনাদের কষ্টের ফলাফল হিসেবে রাতে মুরগির যে তরকারী আমরা খেয়েছিলাম- আহা! এক কথায় অমৃত!

রসুইঘরেই পরিচিত হই ‘ডেংচং’ এর সাথে।  এটা মূলত একটা বাশেরচোঙ, এর ভেতর আদা, রসুন ইত্যাদি ইত্যাদি মশলা বাটা হয় পাহাড়ের ঘরে ঘরে। ডেংচং-এ আমার কাজ ছিল বার্বিকিউয়ের জন্য কাঁচা পেঁপে ভর্তা করা। যদিও কেউ বলেনি, তবে মাঝে মাঝে নিজের ঢোল নাকি নিজেকেই বাজাতে হয় তাই এখানে বলে দেই, বার্বিকিউ যে এতো মজার হয়েছিলো, তার কারণ কি জানেন? ডেংচং-এ করা আমার সেই কাঁচা পেঁপে ভর্তা! সে যাইহোক, সেদিন রাতে সফলতার সাথে, লক্ষ নক্ষত্রের নিচে বার্বিকিউ উপভোগ জীবনের আনন্দের স্মৃতিতে যোগ করে এক নতুন পাতার! সেইসাথে, কাকতালীয়ভাবে আবিষ্কৃত হয় দিনটি আমাদের প্রিয় খোরশেদ ভাই-এর জন্মদিন! আনন্দের বিশেষ উপলক্ষ তো বটেই।


সে রাতে কনকনে শীত কোনভাবেই আর আমাকে ছবি তোলা থেকে আটকে রাখতে পারেনি। আশা ছিল মিল্কিওয়ে এর ছবি এবার তুলতে পারব কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি এবারেও। নতুন ক্যামেরায়, আনাড়ি হাতে, তবুও বেশকিছু তারাভরা রাতের আকাশের ছবি তুলে মনকে শান্ত করলাম।


এবার ঘুমুবার পালা। আগামীকাল দারুণ একটা জার্নি হবে, অনেকগুলো পাড়ায় যাবো আগে কখনই যেগুলোতে যাবার সুযোগ হয়নি। এসব ভেবেই খুব ভালো লাগছিলো তবে সাথে একটা ভয়ও কাজ করছিলো, কিভাবে কি করবো কারণ আগামীকাল পাড়ি দিতে হবে সুদীর্ঘ পথ। সারাদিন হাঁটতে হবে, শেষের দিকের রুটটাও খানিক নতুন, বেশ অনেকদিন ধরেই কেউ ব্যবহার করে না। সব মিলিয়ে বেশ রোমাঞ্চকর একটা দিন অপেক্ষা করছে, বোঝাই যায়! 

দিন ৪--

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই, হাতমুখ ধুয়ে, হাল্কা নাস্তা করে যাত্রা শুরু করে দিলাম। পথ অচেনা, আমাদের গাইডও খুব একটা নিশ্চিত না রাস্তা সম্পর্কে। পাড়ায় বেশ কয়েকজনকে খুঁজে একজন পাওয়া গেলো যারা এ রুট চেনেন। তাকেও তাই সাথে নিয়ে নেয়া হল। এবার হাটা শুরু। পেছনে রেখে এলাম রঙিন কিছু স্মৃতি যার রেশ রয়ে যাবে দীর্ঘদিন। আবার দলিয়ান পাড়ায় আসতেই হবে, এই সংকল্প মাথায় রেখে এগিয়ে চললাম আমরা- গন্তব্য শেরকর পাড়া (তাজিংডং-এ ওঠার বেসক্যাম্প)।


পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ চলতে চলতে প্রথমেই অতিক্রম করলাম মায়োচিং পাড়া। পথ যেহেতু দীর্ঘ, তাই পাড়ায় সময়ক্ষেপণ না করে এগিয়ে চললাম আমরা। এভাবেই একে একে খিওচিং পাড়া, উলাচিং পাড়া পার হয়ে পৌঁছে গেলাম সবার পরিচিত জিন্না পাড়ায়। গতানুগতিক রুট হচ্ছে রেমাক্রি দিয়ে জিন্না পাড়ায় যাবার কিন্তু আগে থেকেই আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গতানুগতিক রুটে না গিয়ে নতুন পথের ছিটিয়ে থাকা সুন্দরগুলো অবলোকন করার অভিপ্রায়ে, ভিন্ন এই রুট ধরে শেরকর পাড়ার উদ্দেশ্যে আমাদের এগিয়ে চলা। বেশ সুন্দর কিছু ঢালু পাহাড়ি পথ, অল্প লোকসমাগম, নতুন পাড়া, মানুষের অনুপস্থিতিতে অনুরক্ত সবুজ- সব মিলিয়ে শেষ শীতের সেই যাত্রা আজও স্মৃতিপটে অমলিন। জিন্না পাড়া পার করে একটু উচু পথ সামনে পড়লো এবার। মোটামুটি তিনটি বড় পাহাড় পার করতে হবে শেরকর পাড়া পৌঁছাতে। সরাসরি শুধুই উঠে যাওয়া অথবা নেমে যাওয়া নেই। পাহাড়ে উঠতে হবে আবার নামতে হবে, এই করেই এগিয়ে যেতে হবে। রৌদ্রের প্রখরতায় কিছুটা কষ্ট হলেও বেশ ভালই লাগছিলো এই পথ। মাঝের নতুন গড়ে ওঠা  চিখিয়ংপাড়া এসে আমরা ঠিক করলাম এখানেই আমাদের দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়ার। অল্প কিছু ঘর নিয়ে এই পাড়া। আমরা পৌঁছুতেই পাড়ার সবাই একটু একটু করে আমাদের দেখে গেলো। দলিয়ান পাড়া থেকে হেটে এই রুটে শেরকর পাড়া যাচ্ছি শুনে সবাই একটু অবাকই হল। 

চিখিয়ংপাড়া থেকে মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে, বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু পথচলা। এবারের গন্তব্য জুলু পাড়া। জুলু পাড়া পৌঁছাবার আগে শেষ যে পাহাড়টার চূড়ায় উঠতে হয়, সেখান থেকে অতিঅবশ্যই যে কাজটা করা উচিত তা হচ্ছে, একটু থেমে, পেছনে ফিরে দেখা! একই সাথে সাকা হাফং থেকে শুরু করে জোতলাং পর্যন্ত সারিবেধে বাংলার সুউচ্চ সব চূড়া একসাথে দেখবেন আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। এই ট্রিপে বেরুবার আগে অথবা গতকালও ভাবতে পারিনি, এমন দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ আমাদের হবে! এতো দূর থেকেও যোগীর চূড়া দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না, এই সেদিনই ওই চূড়া থেকে নেমে আসলাম আর আজ কতদুর! আমাদের সবক্ষেত্রেই আসলে, এগিয়ে যাবার পথে, একটু থেমে, পেছনে ফিরে দেখা দরকার। পাহাড়ে ভ্রমণ শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া নয়, পেছন ফিরে, ভিন্ন আঙ্গিকে ফেলে আসা পথটা দেখবারও। যাইহোক, ক্যামেরায় এই সৌন্দর্য ধরে রাখবার চেষ্টা করে, চোখ দিয়ে মনের ক্ষুধা মিটিয়ে আবার শুরু হল আমাদের এগিয়ে চলা।


পথিমধ্যে হঠাৎ প্রেয়সীর লাজুক দৃষ্টির মত মোবাইল নেটওয়ার্ক এর দেখা পেতেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তিনদিন ধরে বাসার সাথে যোগাযোগ নেই। এই সুযোগে তাই সবাইকে একবার করে ফোন করে, কথা বলে নিলাম। সামনে আবার কোথায় কখন নেটওয়ার্ক পাই, কে জানে! 

সেখান থেকে বেশ কিছু পথ নেমে পৌঁছে গেলাম আমরা জলু পাড়ায়। এদিকে বেলা পড়ে আসছে, আর এই পাড়ায় আসলে সেভাবে দোকানপাট নেই, দুদণ্ড যে বিশ্রাম নেবো, সে সুযোগও নেই। পথ আরও অনেক বাকি। কাজুবাদামের বিশাল এক বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হাজির হলাম ওয়াই জংশনে। ডানের পথ ধরে গেলে দোতং পাড়া আর বামে গয়ালের চলাচল করবার পথ এবং এই পথ বেশ  ক‘বছর ধরেই জনমানবের ঝঞ্ঝাটমুক্ত। আমরা সঙ্গতকারণেই দোতং পাড়া যেতে আগ্রহী ছিলাম না এবং দোতং পাড়া আমাদের মূল পরিকল্পনার অংশও ছিল না। আমরা বামের পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। তানিন ভাই ম্যাপ্স.মি অনুসরণ করে আমাদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই পথ আমাদের গাইডেরও ভুলে যাওয়া। তার ভাষ্যানুযায়ী বেশ কয়েকবছর আগে এই পথে উনি গিয়েছিলেন, এখন ঠিক সেভাবে মনেও নেই। আমরা জানতাম এই পথ আমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে এবং সেভাবে আমাদের প্রস্তুতিও নেয়া। তবে এই চ্যালেঞ্জেই তো মজা, এভাবে হারিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আসা।

এদিকে দিনের আলো নেভার পথে। আমরা গয়ালের পথ ধরে বাঁশ-ঝোপঝাড় ভেঙে, একজন আরেকজনকে ধরে ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছি। মাথার উপর আকাশ দেখার জো নেই। আমাদের দ্বিগুণ উচ্চতার ঝোপ ভেঙে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। ঝোপের কারণে বোঝা দায়, যেখানে পা ফেলছি ওখানে মাটি আছে না খাদ! অবলম্বনের জন্য তেমন কিছু নেই। শনের ঝোঁপ আঁকড়ে ধরে আর যাইহোক, পাহাড় নামা চাট্টিখানি কথা নয়। এই পথে শেরকর পাড়া যাবার সময় আমাদের হিসাব অনুযায়ী একটা ঝিরি পরার কথা। কিঞ্চিত মরিয়া হয়েই সে ঝিরি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। পাহাড়ের নিয়ম মেনে ইতোমধ্যেই অন্ধকার জেঁকে বসতে শুরু করেছে। ঘণ্টাখানেক এভাবেই, একটু একটু করে সামনে আগানোর পর হঠাৎ করেই গাইডের সশব্দ চিৎকারে সচকিত হয়ে আবিষ্কার করলাম শেষপর্যন্ত আমাদের বহুল আরাধ্য ঝিরি পাওয়া গেছে। আমরা সবাই একে একে ঝিরি পথে প্রবেশ করলাম। এবার শুরু হল নতুন চ্যালেঞ্জ। এই ঝিরিতে কতদিন মানুষের পা পড়েনি খোদামালুম! শ্যাওলার পুরু আস্তরণ ঝিরির সব পাথরের ওপর। সবার হাতে টর্চ লাইট। এই অবস্থায় এই পিচ্ছিল, পাথুরে ঝিরিতে পা ফেলে রীতিমত ছুটে চলা এক বিশাল পরীক্ষাই বটে। টর্চের আলোয় সবাই সবার সহযোগিতায় একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছি। কোথায় কখন পা ফেলছি তার নেই ঠিক, সাপখোপের কথা আর নাই বলি। মাথাতেই আসতে দেইনি! তবে যে পথ ধরে যাচ্ছি, সবুজ পিট ভাইপার বা তার কোন ভাই ব্রাদার সহসাই যদি এসে উৎপাত করে, কিচ্ছুটি করার থাকবে না।

এভাবেই একসময় সবকিছুর মত এই পাথুরে ঝিরি পথটুকুও অতিক্রম করে ফেললাম আমরা। তবে আবার শুরু হল পাহাড়ে ওঠা। অন্ধকারে পাহাড়ে ওঠা এমনিতেই এক কষ্টসাধ্য কর্ম, তারপর পথ একদমই আনকোরা! ঝোপঝাড়, লতাপাতা ছিড়ে-কেটে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় স্রেফ মাথা নিচু করে, কুঁজো হয়ে পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে, মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবকাশটুকু নেই! সবার গলদঘর্ম দশা! কখন শেষ হবে পথ, আদৌ এই পথে গিয়ে পৌঁছাতে পারবো কিনা সেই আশঙ্কা সর্বক্ষণ। একপর্যায়ে এক পাহাড়ের উপর উঠে একটু সমতল পেয়ে সবাই বসে গেলাম। একটু বিশ্রাম না নিলেই আর হচ্ছে না! এবং তখনই বহুল আকাঙ্ক্ষিত মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলো। যদিও লাভের লাভ কিছুই হল না। নেটওয়ার্ক আসে যায়- এতে কোন যোগাযোগ করা সম্ভব না। টর্চ বন্ধ করে, সবাই যখন বসে আছি, তখনই ঠিক গাইডের চোখে ধরা পড়ে আলো, পাড়ার আলো! এবং আমরা একটু দম ফেলার সুযোগ পেলাম। যাক! শেষপর্যন্ত আমরা পাড়ার কাছাকাছি! এতটুকুই যথেষ্ট ছিল ক্লান্ত সবাইকে আবার উজ্জীবিত করার জন্য। এবার সবাই রীতিমত ছুট লাগালো। আর একটা পাহাড় উঠলেই আমাদের আজকের গন্তব্য শেরকর পাড়া।


ক্লান্ত পা আর চলতে চায় না। এর মধ্যেই আস্তে আস্তে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। সবাই এগিয়ে গিয়েছিলো, শুধু আমি পিছে আর ক্লান্ত আমাকে সঙ্গ দিতে খোরশেদ ভাই আমার সাথে। দুইজন আমরা সবার শেষে গিয়ে উঠলাম পাড়ায়! পথে এক জুম ঘর থেকে ফারিহা আপু কিছু টক ফল নিয়েছিলেন। সেই ব্যাগটা ছিল আমার কাছে। ওখান থেকেই টুক করে গোটাকয়েক ফল পেটে চালান করে দিলাম এবং সেই ক্লান্তিকর, এই রুটের শেষ অংশে এসে বেশ ভালো সাপোর্ট দিলো। 

পাড়ায় ঢুকেই একপ্রকার ছুটে গেলাম পানির খোঁজে এবং ঠাণ্ডা পানিতে গলা ভিজিয়ে তারপর শান্তি। আমাদের গাইডের ঠিক করা ঘরে পৌঁছে এবার সুযোগ এলো গা ছেড়ে বসার! একটু জিরিয়ে হাতপা ধুয়ে সটান শুয়ে পরলাম। তবে কাজ আরও বাকি! এখনই ঘুমিয়ে পরার সুযোগ নেই কোন। খাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে। প্রচণ্ড খিদা থাকায় সবার ব্যাগ খুঁজে খুঁজে বিস্কিট, চকলেট, কলা - যা পেলাম সব পেটে চালান করতে থাকলাম! 

শরীরে একটু শক্তি ফিরে আসতেই আমরা নেমে গেলাম রান্নাবান্নায়। আমি এবারেও ডেংচং দিয়ে মসলা পিষতে শুরু করলাম। তানিন ভাই, ফারিহা আপু, নিপু ভাই লেগে গেলো মুরগি রান্নায়। ওদিকে ভাত তৈরি হচ্ছে। একসময় রান্নার পাট সম্পূর্ণ হল এবং খাবারের গামলায় আমরা হামলে পরলাম। চেটেপুটে  সবশেষ করে ঘুমুবার ব্যাবস্থা করে শুয়ে পরলাম সবাই। শুয়েই খেয়াল করি, এখানে ঠাণ্ডা একদমই অনুপস্থিত! অথচ মাত্রই গতকাল দলিয়ান পাড়ায় চারটা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হয়েছে! একদমই বুঝে উঠতে পারলাম না কি ঘটনা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরলাম এবং সমাপ্ত হল দুর্দান্ত একটা দিনের! 



দিন ৫--

আজকেই তাজিংডং ঘুরে এসে আমাদের এবারের বান্দরবান ভ্রমণের ইতি টানা হবে। ৪-৫টা দিন কিভাবে কেটে গেলো, সকালে ঘুম থেকে উঠে একপাশে বসে ভাবতে লাগলাম। মনে হচ্ছে মাত্রই না আসলাম আলিকদম, তারপর দলিয়ান পাড়া আর এখন এই শেরকর পাড়া! এসব ভাবতে ভাবতেই তাড়া - জলদি তাজিংডং ঘুরে আসি ভাই, তারপরতো আজ আবার ফিরতে হবে থানচি! 

পাড়া থেকে তাজিংডং এর চূড়া ঘণ্টা দুয়েকের পথ। সকাল সকাল গিয়ে, সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের বাচিয়ে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই পাড়ায় ফিরে আসতে চাই- সেভাবেই রওয়ানা হয়ে গেলাম। পথ মোটামুটি সহজ, অনায়াসেই যে কেউ ঘুরে আসতে পারবে। তবে তাজিংডং যেতে বড় চ্যালেঞ্জ মূলত বোর্ডিং পাড়া থেকে শেরকর পাড়া উঠে আসাটা। এই পথটা দীর্ঘক্ষণ  ধরে উঠে আসতে হয় এবং তখনই মোটামুটি সবার এনার্জি শেষ! ওতটুকু কষ্ট করতে পারলেই বাকিটা একদম সহজ! 


যাইহোক, আমাদের ওই ঝামেলাটুকু নেই, তবে একদম ঝামেলামুক্তও না আমরা। আমাদের এই পথটা নেমে যেতে হবে এবং সেটাও যথেষ্ট পরিশ্রমের! তারওপর পাহাড়ের রোদ। সাথে আবার আমাদের সময় ধরে পৌঁছানোর একটা ব্যাপার ছিল। টার্গেট ছিল থানচি পৌঁছে বান্দরবানের বাস ধরার, যার শেষ সময় দুপুর ৩টা! তাই এর আগেই আমরা পৌঁছাতে চাই। বোর্ডিং পাড়া থেকে প্রায় ৮ কিলো এগিয়ে গিয়ে একটা গাড়ির রাস্তা আছে, ওখানে যাওয়াই সমীচীন মনে করলাম কারণ ৩টার বাস ধরতে হলে আমাদের একটা চাঁদের গাড়ী নিতেই হবে এবং সেই ৮ কিলো সামনে বাদামবাগান ছাড়া আর গাড়ি পাওয়া যাবে না! সেভাবেই যাত্রা করলাম আমরা! একটু কস্ট হলেও মোটামুটি অনাড়ম্বরভাবেই বোর্ডিং পাড়া অতিক্রম করলাম এবং তারপরেই শুরু হল এ যাত্রার শেষ পরীক্ষা। পথ অল্প কিন্তু খাড়া এবং মাথার উপর নেই বিন্দুমাত্র ছায়া! রোদে পুরে ছারখার হয়ে সবার প্রায় ত্রাহি ত্রাহি দশা! ৫ মিনিট হাঁটি, তো ২ মিনিট ঝোঁপের নিচে ছায়া খুঁজি! এভাবে অল্প অল্প করে, আল্লাহ তায়ালার রহমতে, কোনক্রমে বাগান পর্যন্ত পৌঁছালেও, সময় বেশি লেগে যাওয়ায় বাস ছেড়ে দিতে হল। প্ল্যান বি ছিল চাঁদের গাড়ি নিয়ে সরাসরি বলিপাড়া হয়ে বান্দরবান। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী থানচিতে খানিক বিরতি নিয়ে, গাইড দাদাদের বিদায় দিয়ে সোজা বলিপাড়া ক্যাম্প। বরাবরের মতই বলিপাড়ায় সুস্বাদু মধ্যাহ্নভোজ এবং ওখান থেকে বান্দরবান গিয়ে বাস এবং নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন। এর মধ্য দিয়েই আমাদের এবারের ট্যুর এর ইতি। 

ভিডিও লিঙ্ক - https://youtu.be/9IyWvUD5xdQ

এ গল্পেরও এখানেই সমাপ্তি। সমাপ্তিতে এসে এ গল্প আসলে কিসের গল্প হয়ে উঠলো, তা আমার নিজেরই বোধগম্য না। গল্পটা হতে পারে প্রায় ১০০ কিলো পাহাড়ি পথে হাটার গল্প, হতে পারে গয়ালের রাস্তায় মানুষের হেটে যাবার গল্প অথবা দীর্ঘদিন মনুষ্যবর্জিত, ভুলে যাওয়া এক রুট ধরে, পথ তৈরি করে, সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলো পথ পাড়ি দেবার গল্প।

গল্পটা যোগী হাফং বা তাজিংডং -এ আরোহণের গল্প হলেও হতে পারে! কিন্তু ৪ রাত ৫ দিন ধরে ৯৪ কিলো হাইকিং এর পর, পিক সামিট এর গল্প আসলে পাহাড়ে কিছু ‘তথাকথিত’ পথভোলা মানুষের ঘুরে বেড়াবার গল্পই রয়ে গেলো কিনা তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব পাঠকের হাতে তুলে দিয়েই আমি ক্ষান্ত দিলাম!

পরিশেষে, এ গল্পের সাথে একটা ক্ষুদ্র ভিডিও জুড়ে দিচ্ছি, যা আসলে নিতান্তই ভ্রমণকালীন ক্ষুদ্র তবে আনন্দদায়ক মুহূর্তের জোড়াতালি বলা যেতে পারে। এবং সেইসাথে প্রকৃতিকে তার মত করে থাকতে দেয়ার একটা অনুরোধও জুড়ে দিচ্ছি। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরতে গিয়ে গাছপালা মুক্ত পৃথিবী গড়ার যে অভিপ্রায় দেখি, তা আনন্দিত করে না। ঠিক একইভাবে অপচনশিল বস্তু পাহাড়ে রেখে আসার যে প্রতিযোগিতা, তা থেকেও সবাই বিরত থাকার আহ্বান জানাই, আখেরে লাভ কিন্তু আপনারই!

পাহাড়ি পথে দীর্ঘ সময় ঘুরে বেড়াবার পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যতিত, এই লেখা পড়ে আপনি যদি এ পথে বের হয়ে পড়েন, তাতে আপনাকে ঘর থেকে বের করার দায়ভার লেখক কিঞ্চিত নিলেও, পথিমধ্যে সকল যাতনার দায়ভার আপনার একার! তাই অতীত অভিজ্ঞতা না থাকলে, অনুরোধ করবো, আপাতত এই রুট অনুসরণ না করলেই ভালো করবেন।

ভালো থাকবেন সবাই!


Comments

Popular posts from this blog

আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ - Azgar Ali Chowdhury Jam-e Masjid

আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ আনুমানিক ১৭৯৫ সালে আজগর আলী চৌধুরী নামে একজন স্থানীয় ব্যক্তি এই মসজিদটি তৈরি করেন এবং উনার নামানুসারে এই মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ’। নগরীর হালিশহরস্থ চৌধুরীপাড়া বাজারের থেকে অল্প সামনে, ১০ শতক জমির ওপর এবং প্রায় ৩০ জন মানুষ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ২৫০ বছরের পুরনো মসজিদটি বর্তমানে সংস্কার করে, প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে এর পশ্চিম দিকে আরেকটি নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়, যার চারপাশে লেকের আদলে এবং দূর থেকে পানির ওপর ভাসমান স্থাপনা বলে মনে হয়। মোঘল স্থাপনাকে অনুকরণ করে তৈরি করা এই মসজিদটিতে রয়েছে ২৪ টি মিনার আর তিনটি গম্বুজ। এই মসজিদটির একটি লক্ষণীয় বিশেষত্ব হচ্ছে জানালার অনুপস্থিতি। এছাড়া প্রবেশদ্বারের আকারও খুব ছোট। কালের বিবর্তনে খানিক মাটিতে দেবে যাবার কারণে মসজিদটি একটু এক পাশে বাঁকা! হয়তো আর বেশিদিন নেই এই ঐতিহাসিক স্থাপনা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবার। সময়ের পরিক্রমায় আর্কিটেকচারাল জৌলুস অনেকটাই কমে গেলেও এর সামনে যখন আপনি দাঁড়াবেন, সেই সময়ের কথা ভেবে আপনার মন উদাসী হতে বাধ্য। Azgar Ali Chowdhury Jam-e Masjid The mosque was

খাঁন সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া জামে মসজিদ - Khan Sahib Abdul Hakim Mia Jam-e Mosque

  খাঁন সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া জামে মসজিদ চট্টগ্রামের আরেকটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ হিসেবে পরিচিত নগরীর মন্সুরাবাদে অবস্থিত খাঁন সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া জামে মসজিদ। বয়সে প্রবীণ এই মসজিদটি কিছুদিন আগেই ছুয়েছে শতবর্ষের মাইলফলক। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেল বর্তমানে এই মসজিদটির বয়স ১৩৭ বছর। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে রেনোভেশনের কাজ চলছে এই মসজিদটির। মসজিদটির চারপাশে রয়েছে বেশকিছু পুরনো কবর। ভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এই মসজিদটির ভেতরে মূল কক্ষ এবং এবং চারপাশে রয়েছে বর্ধিত অংশ। দেওয়ানহাটের মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিস ফেলে সামান্য একটু সামনে গিয়ে, হাতের বামপাশ দিয়ে যে গলিটি গেছে, তা ধরে সোজা ৫-৭ মিনিট এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে এই অনিন্দসুন্দর মসজিদটির। Khan Sahib Abdul Hakim Mia Jam-e Mosque Khan Sahib Abdul Hakim Mia Jam-e Mosque is located near Mansurabad, Dewanhat is also known as another beautiful mosque of Chittagong. This age-old mosque has recently reached the milestone of the centenary. Talking to the locals, I came to learn that the mosque is now 137 years old. The mosque has