লাদাখ যাবার রাস্তা দুটো, দিল্লী থেকে মানালি হয়ে অথবা শ্রীনগর দিয়ে । এই দুই পথে ফেরাও যায় । অধিকাংশ মানুষ এক পথে যায় এবং অন্য পথে ফিরে আসে । আমাদের প্ল্যানও সেরকমই ছিল কিন্তু মানালি দিয়ে যে রাস্তা, তা বরফের কারণে বন্ধ ছিল । যার কারণে ওই পথে যাওয়া বা আসা কোনটাই আমাদের হয়ে ওঠে নি । আমরা লাদাখ থেকে ফেরার ২-৩ দিন পরেই অবশ্য রাস্তাটা খুলে দেয়া হয় । সময়স্বল্পতার কারণে আমরা অপেক্ষা করতে পারি নি নতুবা দুদিন বেশি থেকে মানালি রাস্তা দিয়েই আমরা দিল্লী ফিরতাম ।
শ্রীনগর থেকে লাদাখ যাবার ব্যাপারে আসলে যা বলবো তাই কম বলা হবে । পথের দূরত্ব প্রায় ৪২০ কিলো, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, কোথাও বরফ, কোথাও কাঁদা, কোথাও আবার সুন্দর পিচঢালা রাস্তা । এই রাস্তা যে কি রাস্তা তা আসলে বুঝতে হলে স্বচক্ষে অবলোকন এর কোনই বিকল্প নেই । প্রথমেই পড়ে সোনমার্গ – বরফে ঢাকা সোনমার্গ এক অনিন্দ্যসুন্দরি । যদিও সোনমার্গ-এ একদমই সময় আমরা ব্যয় করি নি, কারণ আমাদের প্রধান লক্ষই ছিল লেহ-লাদাখ আর এতো দুরের পথ, সময় খুব সাবধানে হিসাব করতে হয় । এর সাথে আছে রাস্তায় ট্র্যাফিকএর হ্যাপা । তাই আমরা ছুটে চলার সিদ্ধান্তই নেই । পথে যে যে জায়গা পড়ে তারা নিজগুণে একএকটা লেজেন্ড! কারগিল, দ্রাস, জজিলা পাস, লামায়ুরু – দ্যা মুনলান্ড, সাস্পুল । গাড়ি থেকে নেমে নেমে ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাবে যে কেউ! এতো বৈচিত্র্য এই রাস্তায়। আমরা সবাই কথা বলা ভুলে শুধু দেখায় মগ্ন ছিলাম । গাড়ি থেকে নামলেই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা, মাইলের পর মাইল বিরানভূমি । লাদাখকে বলা হয় ‘ডেসার্ট ইন দ্যা স্কাই’- আদপেই তাই, আকাশের উপর মরুভূমি! এবং এই মরুভূমি ঠাণ্ডা, শুধু ঠাণ্ডা না, মারাত্মক ঠাণ্ডা । ছবিতে হাল্কাপাতলা চেষ্টা করা হয়েছে লাদাখের পথের সৌন্দর্য তুলে ধরার তবে তাতে মনে হয় না খুব একটা সফল হতে পেরেছি ।
লেহ সিটিতে পৌছাতে পৌছাতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিলো । সেই জাভেদ ভাইয়ের সহায়তায় একটা হোটেল ঠিক হল, নাম – দ্যা গোল্ডেন এপ্রিকট । দারুন এক হোটেল, সকালে এর বারান্দায় এককাপ চা নিয়ে সামনের বিশাল বরফে ঢাকা পাহাড়রাজি দেখার যে অনুভুতি, তা মনে থাকবে দীর্ঘদিন । হাতে সময় কম, তাই পাহাড় দেখা বাদ দিয়ে ছুটে গেলাম পারমিটের জন্য । ‘দুরুদুরু বক্ষে’ লেহ সিটির মেইন মার্কেট-এ টিআইসি অফিসে গেলাম পারমিটের জন্য । পাওয়ার সম্ভাবনা কম জানতাম । ফরেনারদের দিল্লী থেকে পারমিট আনতে হয়, তারপরেও চেষ্টা করা । এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই পারমিট আমরা পাইনি । যার ফলে খারদুংলা, পেংকং লেক, নুব্রা ভ্যালি আমরা যেতে পারি নি । লেহ সিটির লেহ প্যালেস, শান্তি স্তুপা, শে প্যালেস, ম্যাগনেটিক হিল-এর মধ্যেই আমাদের ঘুরাঘুরি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো । সারাদিন এই জায়গাগুলো আমরা মোটামুটি ঘুরে ফেললাম । লেহ সিটির ভেতরে ঘোরার জন্য আলাদা গাড়ি নিতে হয়, হোটেল থেকেই ব্যাবস্থা করে ফেলা সম্ভব । সারাদিন সমগ্র লেহ সিটি ঘুরলাম আমরা, আমাদের দুজন সহযাত্রী বিখ্যাত রয়েল এনফিল্ড বাইকে চষে ফেললো এই শহরের রাস্তাগুলো । লেহ ঐতিহ্যবাহী এক শহর । শতবছরের পুরনো প্রাসাদ, লেহ প্যালেস এবং শে প্যালেস । এই প্রাসাদে একসময় এখানকার মহামহিম, অনেক ব্যাক্তিত্ত ঘুরে বেরাতেন, ভাবতেই কেমন লাগে! কেমন ছিলেন তারা? যে করিডরে আমি হেটে বেড়াচ্ছি, কতশত বছর আগে, অন্য কেউ, কি ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন? যে প্রাচীন দেয়াল আমি স্পর্শ করছি, কেউ কি ঠিক সেই জায়গাতেই স্পর্শ করেছিলো? কত গল্প-কে জানে? বিস্ময়কর!
একেএকে গেলাম শান্তি স্তুপা-যার দেয়ালে চিত্রিত গৌতম বুদ্ধের জীবন । গেলাম শে প্যালেস, একসময় যা ছিল স্বর্ণাবৃত। গেলাম লোকাল তিব্বতি মার্কেটে, ঘুরলাম লেহ-লাদাখ সিটির গলিঘুপচি । স্থানীয় অলঙ্কার, স্থানীয় পোশাক, স্থানীয় মানুষ, ঘুরলাম দেখলাম সব এবং ঠিক তখনি মনে সংকল্প করে ফেললাম, স্বদেশ থেকে ৩,২০০ কিলো দুরের এই মায়াবী প্রদেশে আমি আবার আসবো, আসতেই হবে! লেহ-লাদাখ এখন আরেক ভালোবাসার নাম!
লেহ-লাদাখ থেকে ফেরার সময় আমরা যাত্রা শুরু করি দুপুরের ঠিক একটু আগে । পরিকল্পনা ছিল রাতে থাকবো লামায়ুরু-তে । পথিমধ্যে যদিও পরিকল্পনার পরিবর্তন করে আমরা সরাসরি শ্রীনগর ফেরত আসি । দিল্লীতে কিছু জায়গা ঘুরা, দেশে ফেরার তাড়া, এসব থেকেই পরিকল্পনার পরিবর্তন । এসব ঠিক করতে করতেই আমরা যাত্রা বিরতি নেই লামায়ুরুতে । লামায়ুরু এর আরেক নাম ‘মুনল্যান্ড’ । রাতের বেলা, যখন নেই কোন কৃত্রিম আলো, তখন চাঁদের আলোয় লামায়ুরু সংলগ্ন পাহারগুলো রীতিমত জ্বলজ্বল করে । এর পেছনে কারণ হল পাহাড়ের বিশেষ ধরণের মাটি । পাহাড়ের চুড়ার অংশগুলো কালচে এবং নিচের অংশ তুলনামূলক সাদা মাটি । আমরা যখন লামায়ুরুতে বিরতি পালন করছি, তখন চাঁদের আলো ছিল না, তাই ক্যামেরাতে সেই পাহাড়ের ছবি তুলতে পারি নি । প্রায় ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষার পর, চাঁদের এহেন রুপ দেখে আমরা লামায়ুরু পেছনে ফেলে ফের শ্রীনগর-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি । পরবর্তী কোন সময় নিশ্চয়ই আমি আবার চেষ্টা করবো ‘মুনল্যান্ড’-কে ক্যামেরা বন্দি করার । এই যাত্রায় এই আফসোসটা রয়ে গেলো ।
রাত আনুমানিক ৩টার দিকে আমরা কারগিল পৌছাই । লামায়ুরু থেকে কারগিল পর্যন্ত গাড়িতে করে রাতের সে ভ্রমণ ছিল আরেক রোমাঞ্চ! আমি আগে কখনো রাতের মরুভূমি দেখি নি । সৃষ্টিকর্তার করুণায় এবার তাও দেখা হয়ে গেলো! নিচে সাদা বিরানভূমি আর উপরে তারায় ভরা কালো আকাশ! এতো তারা! সাথে ঠাণ্ডা-হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা! তবে মন্দ লাগে না । আমি গাড়ির পেছনে বসে, হা করে তারা দেখতে দেখতে কখন যেন কারগিল পৌঁছে গেলাম । কারগিল পৌঁছে লোকাল পুলিশ আটকে দিলো । সামনে বরফে রাস্তা বন্ধ, ভোর পাঁচটার আগে তাই আর যেতে পারলাম না । কারগিলের ওখানে তাই গাড়ির ভেতরে বসেই দিলাম ঘুম । বাইরে ঠাণ্ডা তখন -৩/-৪ ডিগ্রি । ঘুম যখন ভাঙলো তখন আমাদের পাইলট জাভেদ ভাই গাড়ি নিয়ে শ্রীনগর ঢুকছেন । শ্রীনগর ঢুকেই একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম । এবার বিদায় বেলা । জাভেদ ভাইকে বিদায় দিলাম । লোকটা ভালো, আমাদের অনেক কষ্ট শুধুমাত্র উনার কারণেই কমে গেছে । হোটেল ঠিক করা, কোথায় কখন গেলে ভালো হবে এবং সর্বোপরি উনার অসাধারণ ড্রাইভিং । এরকম একজনকে পেয়ে আমরা আসলেই নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেছি । উনি আরেকটা গাড়ি ঠিক করে দিলেন শ্রীনগর থেকে জম্মু যাবার জন্য । লাদাখ থেকে শ্রীনগরের ১৩ ঘণ্টার জার্নি এবং তারপরই শ্রীনগর থেকে জম্মু, শুরু হল আমাদের ১০ঘন্টার জার্নি । আবার ফিরে আসলাম গরমে । যতই জম্মুর কাছাকাছি যাচ্ছি, গরম বাড়ছে । কি আর করা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমরা অসহায় । জম্মু পৌঁছেই বাস ঠিক করলাম । সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয় নি, তাই এবার খেতে ঢুকলাম জম্মু বাসস্ট্যান্ড-এর পাশেই ‘খানা খাজানা’ রেস্টুরেন্ট-এ । ঢুকার আগে জানতাম না এটা ভেজ রেস্টুরেন্ট । ফ্রেশ হয়ে বসে যখন মেনু দেখলাম দেখি সব ভেজ! কি আর করা, এ অবস্থায় তো আর বের হওয়া যায় না, তাই ভেজ বিরিয়ানি দিয়েই সেরে ফেললাম খানা । এরপর বাস এ উঠে একঘুম এবং সকালে সোজা নামলাম আগ্নেয়গিরি থুক্কু দিল্লী ।
যাবার সময় দিল্লীতে তাপমাত্রা পেয়েছিলাম ৪৪ ডিগ্রি, এসে দেখি তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি! পুরাই ভাজা ভাজা অবস্থা । কোনমতে সিএনজী নিয়ে চলে গেলাম চাঁদনী চক, হোটেল ঠিক করেই গোসল এবং আরেকদফা ঘুম । সবাই এবার একটু ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম মার্কেট-এ । মার্কেট বলতে কন্নাট প্লেস । বিশাল মার্কেট, পুরা মার্কেট ঘুরতেই লাগবে ১ সপ্তাহ! আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ডের দোকানে সয়লাব । আমরা ট্যুর-এ আসছি মাথায় লাদাখ রেখে, শপিং এর চিন্তাভাবনা ছিল না কিন্তু এই মার্কেট দেখে সবাই টুকিটাকি কিছু না কিছু কিনেই ফেললো । সব শেষ করে চলে গেলাম চাঁদনী চক, ইটস ফুড টাইম! দিল্লী জামে মসজিদের বিপরীত গলিতে এক বন্ধুর পরামর্শে পেয়ে গেলাম এক রত্ন – “করিম’স”! খোদ খুশবন্ত সিং যার খাবারের রিভিও দিয়েছেন । প্রাচীন মুঘল খানার স্বাদ পেতে হলে এই চাঁদনী চক এর বিকল্প নেই । আহা! কি অমৃত! মুখে লেগে আছে এখনো । মাটন কোর্মা, বিভিন্ন ধরণের কাবাব, জালালি রুটি, লাচ্ছি, পেস্তা বাদামের শরবত, লিখার সময়ে ওদের স্মৃতি আমার জিভে জল এনে দিচ্ছে! পরবর্তী দুইদিন আমাদের খাবারের পার্মানেন্ট জায়গা ছিল এই চাঁদনী চক । এই সমগ্র ট্যুরের অন্যতম সেরা অংশ ছিল এই চাঁদনী চক-এর খাবার!
পরের দিন সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলাম । ঘুম থেকে উঠে, ঘুরাঘুরি চললো দিল্লীর শাহী জামে মসজিদ, হুমায়ূনের সমাধিতে । এরপর রাত এ আরেকদফা “করিম’স”-এ খেয়ে এসে হোটেলে ফিরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, ঘরের ছেলে ঘরে রওয়ানা দিলাম । অনেক তো হল । তবে পেছনে ফেলে রেখে আসলাম, ৩২০০ কিলোমিটার দুরের লাদাখ, শ্রীনগরের জাভেদ ভাই, গুলমার্গের ঘোড়ায় সওয়ারি অভিজ্ঞতা, “করিম’স”-এর মাটন কোর্মা, দিল্লীর গরম!
সম্পূর্ণ লেখায় কোথাও খরচের কিছুই উল্লেখ করা হয় নি । সম্পূর্ণ খরচ আলাদা করে এবার দেয়া হবে । যেই এই লেখা পরবেন, একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, আমরা যখন গিয়েছি তখন টুরিস্ট সিজন মাত্র শুরু হয়েছে, মানুষ কম বিধায় অনেক কিছুই আমরা অনেক কম খরচে পেয়েছি আর যাই ঠিক করেন, করার আগে ভালভাবে, সুন্দরভাবে দামাদামি করে নিবেন ।
(পূর্ববর্তী দুই পর্বে লেখা অনুযায়ী খরচের হিসাব পাবেন)
লেহ লাদাখ – শ্রীনগর – জম্মু – ১৮,০০০ রুপি (৬ জন)
জম্মু – দিল্লী – (এসি বাস, দুইটা সিত+৪টা স্লিপার) – ৬,০০০ রুপি
দিল্লী হোটেল – (২ দিন) - ৬,০০০ রুপি (শেষ)
ভিডিও লিঙ্ক (২য় পর্ব) - https://youtu.be/BBxLGm4tJ4I
যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশের ক্ষতি করবেন না। একজন ট্রাভেলার হয়ে অন্য ট্রাভেলার কে সম্মান করুন, আপনিও সম্মানিত হবেন। বিশেষ করে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানশীল হোন ।
Comments
Post a Comment